কর্মকর্তা পরিবর্তনের গ্যাঁড়াকলে শরীফের সেই দুর্নীতির অনুসন্ধান

কক্সবাজার পানি শোধনাগার প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে আলোচিত দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে রোষানলে পড়েছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চাকরিচ্যুত উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন।

Feb 2, 2023 - 12:35
 0
কর্মকর্তা পরিবর্তনের গ্যাঁড়াকলে শরীফের সেই দুর্নীতির অনুসন্ধান

কক্সবাজার পানি শোধনাগার প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে আলোচিত দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে রোষানলে পড়েছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চাকরিচ্যুত উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন।

তার অনুসন্ধানে পৌর মেয়র ও আমলাসহ অনেকের সম্পৃক্ততা উঠে এসেছিল। কিন্তু অদৃশ্য কারণে মামলার অনুমোদন আর হয়নি। এরপর অনুসন্ধান কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হলেও অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বড় পরিবর্তন আসেনি।

কক্সবাজার পানি শোধনাগার

  • প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে ৩৫ কোটি টাকা সরকারের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছিলেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। আর ওই অনুসন্ধান প্রতিবেদনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান, কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক (বর্তমানে যুগ্ম-সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়) মো. কামাল হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) (বর্তমানে উপ-সচিব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) আশরাফুল আফসারসহ ৩৭ জনকে আসামি করে মামলার সুপারিশ করেছিলেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক আলী আকবর।


তিনি এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। চাকরি হারানোর আগে কক্সবাজারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে দুদকে অর্ধশতাধিক মামলা দায়েরের সুপারিশ করেছিলেন শরীফ। এ ছাড়া আরও তিন ডজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সম্পদ বিবরণী দাখিল করার অনুমতি চেয়ে কমিশনে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু দুদক অনুমোদন দেয়নি। আগে বেশকিছু মামলা হলেও সেগুলো নতুন করে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে অধিকাংশ সুপারিশ অনুমোদন না হওয়ায় বিষয়টি থমকে আছে।

আরও পড়ুনঃ ঢাকায় আসছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর : ডেরেক এইচ শোলেট

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে


  • ২০১৫ সালে কক্সবাজার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র সরওয়ার কামাল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতায় কক্সবাজার পানি শোধনাগার প্রকল্পের জন্য বাঁকখালী নদীর উত্তরপাড়ে প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা মূল্যের জমি বাছাই করেন। তার দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর নতুন মেয়রের দায়িত্ব পান মুজিবুর রহমান। প্রকল্প নির্মাণে আগের বাছাই করা জমি বাদ দিয়ে বাঁকখালী নদীর দক্ষিণপাড়ে ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা মূল্যের জমি বাছাই করেন। নতুন করে বাছাই করা জমির মধ্যে বেশির ভাগ জমি ছিল সরকারি রিসিভারে থাকা জমি। মেয়র কৌশলে জমি অধিগ্রহণের আগে রিসিভারকৃত জমির ১ দশমিক ৭২ একর তার স্ত্রী ও শ্যালকের নামে ব্যক্তিগত জমিতে রূপান্তর করেন। সরকারি রিসিভারকৃত জমি ব্যক্তির জমিতে রূপান্তর করতে মেয়রকে সহায়তা করেন কক্সবাজারের সদরের সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার মোক্তারসহ আরও দুজন সহকারী কমিশনারসহ (ভূমি) জেলার বিভিন্ন পদের কর্মকর্তারা।
  • প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের জিম্মায় থাকা জমিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন দেখাতে মেয়রকে সহায়তা করেন কক্সবাজার সদরের সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার মোক্তারসহ তিন সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও জেলার বিভিন্ন পদের তৎকালীন কর্মকর্তা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৫ সালের ১৮ মে প্রস্তাবিত বাঁকখালী নদীর উত্তর পাড়ের জমি গ্রহণ না করে সরকারি অর্থের অপচয়, কারচুপি ও আত্মসাতের উদ্দেশ্যে বাঁকখালী নদীর দক্ষিণ পাড়ে ১০ গুণ বেশি মূল্যের জমিতে প্রকল্প নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর ভূমি বরাদ্দ কমিটির বৈঠকে ভূমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রকল্পের জন্য বাছাই করা জমির ২ দশমিক ১৯ একরের মধ্যে সরকারের জিম্মায় থাকা ১ দশমিক ৭২ একর জমিকে মেয়র মুজিবুর রহমান পরিকল্পিতভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন দেখান। মেয়রের স্ত্রী ফারহানা আক্তার ও স্ত্রীর বড় ভাই মিজানুর রহমানের নামে এ জমি দখল দেখিয়ে নামজারির মাধ্যমে ব্যক্তিগত জমিতে রূপান্তর করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ ৪৮ বছরে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ


অন্যদিকে, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত জসিম উদ্দিন গং ক্ষতিপূরণ বাবদ ২ কোটি ২২ লাখ চার হাজার ১৮৭ টাকা পান, সেই টাকা থেকে কমিশন বাবদ এক কোটি ৪৮ লাখ টাকা সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে নিয়েছেন মেয়র মুজিবুর রহমান। এ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকার চেক দেন স্ত্রীর ভাই মিজানুর রহমানকে। দুদকের অনুসন্ধানে দালিলিক ও সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় ৩৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়েরের সুপারিশ করা হয়।

এ বিষয়ে কক্সবাজার মেয়র মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা পোস্ট থেকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

যাদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করা হয়েছে


  • অনুসন্ধান প্রতিবেদনে মোট ৩৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা সুপারিশ করা হয়েছে। তারা হলেন, কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমান, কক্সবাজারের সাবেক ডিসি (বর্তমানে যুগ্ম-সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়) মো. কামাল হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) (বর্তমানে উপ-সচিব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার, সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বর্তমানে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এএইচএম মাহফুজুর রহমান, সাবেক সহকারী কমিশনার ভূমি মোহাম্মদ নূর হোসেন, কক্সবাজার ভূমি অফিসের সাবেক কানুনগো বাচ্চু মনি চাকমা, সাবেক ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা মিজবাহ উদ্দিন, কক্সবাজার সদরের সাবেক সহকারী কমিশনার রাশেদুল ইসলাম, সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও বর্তমানে সিনিয়র সহকারী সচিব (সাময়িক বরখাস্ত) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নাজিম উদ্দিন, উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো বসন্ত কুমার চাকমা, ইউনিয়ন সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাহেদ ও আবুল হোছাইন, ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সৈয়দ নূর, উপজেলা ভূমি অফিসের রেকর্ড কিপার জসীম উদ্দিন, সার্ভেয়ার মো. জাহাঙ্গীর আলম।

আরও পড়ুনঃ পাতাল রেল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী


এ ছাড়া কক্সবাজার সদর ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা জাহেদ হোসাইন, সদরের সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও বর্তমানে বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ শাহরিয়ার মুক্তার, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সরকারি কৌঁসলি (জিপি) মোহাম্মদ ইসহাক, কক্সবাজার পৌরসভা সচিব রাছেল চৌধুরী, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. শামীম হুসাইন, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আতাউর রহমানকে আসামি করতে সুপারিশ করা হয়। আসামি করার সুপারিশ করা হয় জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো মো. নুরুল ইসলাম, সার্ভেয়ার মো. জিয়াউর রহমান ও মো. সাইফুল ইসলাম এবং আইএম আশরাফুজ্জামানকে। মেয়র মুজিবুর রহমানের স্ত্রী ফারহানা আক্তার, স্ত্রীর বড় ভাই মিজানুর রহমান, কক্সবাজার সদরের বাসিন্দা মমতাজুল ইসলাম, মো. মফিজুর রহমান, মাহবুবুর রহমান, খোরশেদা বেগম, মাহমুদা খাতুন, রেজাউল করিম, মোজাফফর আলী, মো. সালা উদ্দিন, জেলা সদরের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের মোস্তাক আহমদ এবং মেয়র মুজিবুর রহমানের ছেলে হাসান মেহেদী রহমানের বিষয়েও প্রতিবেদনে একই সুপারিশ করা হয়েছিল।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow