ঈদ যাত্রায় জনপ্রিয় মোটরসাইকেল

দুই ঈদে শহর ছেড়ে গ্রামে ছোটেন মানুষ। পথের কষ্ট, তীব্র গরম, যানজট, দুর্ঘটনার ঝুঁকি তারপরও কেন গ্রামে যাওয়ার এই যুদ্ধ! এবার এই ঈদ যাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে মোটরসাইকেল।

Apr 20, 2023 - 13:12
 0
ঈদ যাত্রায় জনপ্রিয় মোটরসাইকেল
ছবি: সংগৃহীত

ধারণা করা হচ্ছে যে এক কোটি ২০ লাখ মানুষ গ্রামে যাবেন তার ২৫ লাখ যাবেন মোটরসাইকেলে। এবার মহাসড়কে মোটরসাইকেলে বাধা নেই। আর ঈদের সময় পদ্মা সেতু দিয়েও যেতে পারছেন মোটরসাইকেল আরোহীরা। ঢাকার তরুণ চাকরিজীবী সুমন রায়হান বরাবরই ঈদের সময় মোটরসাইকেলে বাড়ি যান। তার বাড়ি দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায়। 

এবারও তিনি মোটরসাইকেলেই পাড়ি দেবেন দীর্ঘ পথ। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, টিকিট পাওয়া না পাওয়ার ঝামেলা নাই। আর নিজের ইচ্ছেমত সময়ে রওয়ানা দেয়া যায়। পথে বিশ্রাম নেয়া যায়। এখন রাস্তার পাশে একটি লেন মোটরসাইকেলের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়। সবচেয়ে বড় কথা পদ্মা সেতু দিয়ে যেতে পারব।

মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার আশঙ্কার কথা বলা হলে তিনি বলেন, মহাসড়কে আমি নিরাপত্তা ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করি। আর গতিও রাখি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। তারপরও দুর্ঘটনা যেকোনো যানবাহনে হতেই পারে। আমার বন্ধুবান্ধবেরা ৯০ ভাগই এবার ঝামেলা এড়াতে মোটর বাইকে বাড়ি যাচ্ছেন।

আমিন ইকবাল ঢাকায় অনেকদিন ধরে মোটরসাইকেল চালালেও এবারই প্রথম মোটর সাইকেলে করে গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি শেষ রোজার সেহরি খেয়ে বাড়ি রওয়ানা হবো। ওই সময়ে তো কোনো যানবাহন পাওয়া যাবে না। আর এবার লম্বা ছুটি হওয়ায় রাস্তায় যানজট কম। তাছাড়া মোটরসাইকেল নিয়ে বাড়ি গেলে ঈদের সময় ঘোরাঘুরি সহজ হবে। লম্বা ছুটি বলে ভোগান্তি কম।

এবার ঈদে মোট ছুটি পাঁচ দিন। বুধবার থেকে ছুটি শুরু হয়েছে। তবে ঈদ যদি ২৩ এপ্রিল হয় তাহলে ছুটি আরো একদিন বাড়বে। মঙ্গলবার থেকেই লোকজন ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে। লম্বা ছুটি হওয়ায় গ্রামমুখী মানুষ যেমন বেশি, তেমনি রাস্তাঘাটে ভিড় এবং ভোগান্তি গত ঈদের তুলনায় এখন পর্যন্ত কম।

তারপরও বাস, ট্রেনের টিকিট না পাওয়া, বাসে বেশি ভাড়া আদায় করার প্রবণতা আছে। লঞ্চে এখন পর্যন্ত যাত্রীদের ঢল দেখা যাচ্ছে না।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এবার মোটরসাইকেল আরোহী বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য যানবাহনের ওপর চাপ যেমন কমেছে তেমনি ভাড়ার নৈরাজ্যও কিছুটা কমেছে। তবে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েছে। কারণ মোটরসাইকেলে বেশি দুর্ঘটনা হয়। ঈদের পরে বাস্তব চিত্র পাওয়া যাবে।

আর বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, এবার সড়ক ব্যবস্থাপনা আগের চেয়ে ভালো। তবে গতি নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। মহাসড়কে এর কোনো মনিটরিং নেই। নেই স্পিড গান বা স্পিড ক্যামেরা।

ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রায় দেড় কোটি মানুষ ঢাকা ছাড়ছেন বলে শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরাম (এসসিআরএফ) তাদের এক জরিপে জানিয়েছে। যার মধ্যে সড়কপথে যাবে ৬০ শতাংশ। ২০ শতাংশ নৌ ও ২০ শতাংশ রেলপথে যাবে। এ হিসেবে সড়কপথের যাত্রীসংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। তারা বলছেন, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে জনবহুল বড় শহরসহ শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকাগুলোর অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষ বর্তমান আবাসস্থল ছেড়ে যায়। যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানায়, সব মিলিয়ে কম-বেশি এক কোটি ২০ লাখ মানুষ এই ঈদে ঢাকা ছাড়বে।

তবে এই সব হিসাব অতীত অভিজ্ঞতা এবং যানবাহনের ট্রিপ হিসাব করে তৈরি করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে কোনো জরিপ নাই। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানিয়েছেন, মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) ঢাকার বাইরে গেছেন ১২ লাখ ২৮ হাজার ২৭৮ জন এবং ঢাকায় এসেছেন ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮৩ জন। তিনি চার মোবাইল ফোন অপারেটরের তথ্যের ভিত্তিতে এ হিসাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষদের মধ্যে গ্রামীণফোনের তিন লাখ ৩৪ হাজার ২৯৫, রবির তিন লাখ দুই হাজার ২৮৪, বাংলালিংকের পাঁচ লাখ ৭৩ হাজার ৫০৯ এবং টেলিটক ১৮ হাজার ১৯০ জন ব্যবহারকারী।

তবে ফোন সিমের এই হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি লোক মঙ্গলবার ঢাকা ছেড়েছেন বলে বিশ্লেষকেরা বলছেন। তাদের কথা, এই হিসাবের মধ্যে যারা মোবাইল ব্যবহার করেন না তারা নেই। আর পরিবারে শিশু ও অপ্রাপ্ত বয়স্করাও থাকেন। তারা তো মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না।

ঢাকায় নাগরিক মানুষ বা সিটি পিপলের অভাব বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ এবং ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান। তিনি জানান, এই শহরে যারা বসবাস করেন তাদের সর্বোচ্চ ৩০ ভাগের ঢাকা শহরে বাড়ি, ফ্ল্যাট বা নিজস্ব থাকার জায়গা আছে। অন্যরা ভাড়া থাকেন। তারা এই শহরকে নিজেদের মনে করতে পারেন না। তাদের পরিবারের একটি অংশ গ্রামে থাকেন। আবার যাদের শহরে বাড়ি আছে তাদের অধিকাংশের মূল গ্রামে। ফলে উৎসব আয়োজনে শহরের মানুষ গ্রামে ফিরে যান যতই কষ্ট হোক। তারা পরিবার পরিজনের মাঝে শেকড়ের কাছে চলে যান।

তার কথা, এর বাইরে এই শহরে নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা নেই, খোলা মাঠ নেই, সবুজ নেই। ফলে একটু লম্বা ছুটি পেলেই নগরবাসী একটু স্বস্তি পেতে গ্রামে চলে যান। তিনি বলেন, এখন কিছু বিত্তশালী মানুষ ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরেও যান। এদের সংখ্যা কম হলেও এই প্রবণতা বাড়ছে। আর দেশের ভেতরেও ছুটিতে অনেকে ভ্রমণ করেন। চলে যান কক্সবাজার বা অন্য কোনো পর্যটন স্পটে। ঢাকার আশপাশের রিসোর্টগুলো ঈদের ছুটিকে পূর্ণ থাকে। এই শহর একটি অর্থনৈতিক শহরে পরিণত হয়েছে। এখানে জীবিকা, পড়াশুনা বা অন্যকোনো কারণে মানুষ বসবাসে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু প্রাণের শহরে পরিণত হয়নি। আমার শহর হতে পারেনি ঢাকা, মন্তব্য এই নগর পরিকল্পনাবিদের।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow