অর্পিত সম্পত্তি মামলা : প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা জিম্মি জেলা প্রশাসনে

অর্পিত বিত্ত আইনে চার দাগে ৩৯ শতক জমি ফেরত চেয়ে ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন মাদারীপুর পৌর শহরের বাসিন্দা দুলাল কৃষ্ণ বণিক। ২০১৮ সালে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সম্পত্তি ফেরত চেয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত আপিল করেন তিনি।

Jan 24, 2023 - 11:07
 0
অর্পিত সম্পত্তি মামলা : প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা জিম্মি জেলা প্রশাসনে
২১ জেলায় অর্পিত সম্পত্তি আইনে মামলা : সংগ্রহীত ছবি

অর্পিত বিত্ত আইনে চার দাগে ৩৯ শতক জমি ফেরত চেয়ে ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন মাদারীপুর পৌর শহরের বাসিন্দা দুলাল কৃষ্ণ বণিক। ২০১৮ সালে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সম্পত্তি ফেরত চেয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত আপিল করেন তিনি।

তারপর জেলা প্রশাসন রাষ্ট্রীয় উকিলের কাছে অভিব্যাক্তি চেয়ে চিঠি দেন। পাল্টা চিঠিতে আইনজীবী জেলা প্রসাশনকে জানান, এই মামলায় আবেদনের কোনো চান্স নেই। তাই রায় পাওয়া ব্যক্তিকে কৃষিখেত বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য মতামত দেন তিনি।

দুলাল কৃষ্ণ জানান, আইনজীবীর মতামতের পরও আমাকে জেলা প্রশাসন জমি বুঝিয়ে দিচ্ছে না। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ছোটন চন্দনের বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করে তিনি বলেন, আমি উনার সাথে যোগাযোগ করলেই নানা কথা বলেন। এক পর্যায়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অ্যাপ্লাই করা হবে বলা হয়ে থাকে দিনের পর দিন ঘোরানো হচ্ছে। উনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ৪৫ দিনের মধ্যে আবেদনের আইন অমান্য করা হচ্ছে, এর প্রতিকার আমি কোথায় চাইব?

আরও পড়ুনঃ ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে শহীদের রক্ত বৃথা যায়নি: রাষ্ট্রপতি

জানা গেছে, ইদানিং পর্যন্ত দেশের ২১ জেলায় অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনে ৬৪ হাজার আবেদন পড়েছে। এর ভিতরে নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে ২৬ হাজার। অ্যাপ্লাই আপিলের ৫৪ অংশ নিষ্পত্তি হয়েছে। চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকৃত ২ হাজার ৭৬৮টি আবেদনের মাত্র ৫৪৮টি অর্থাৎ ১৯ অংশ সম্পত্তি জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে বৈধ দাবিদারকে হস্তান্তর করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে অর্পিত সম্পত্তির হিসাব ২ লাখ একর। কিন্তু হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান একতা পরিষদের নেতারা বলছেন, সরকারী হিসাবের চেয়ে এমন ভূমির পরিমাণ প্রায় তিনগুণ। 

ঐক্য পরিষদের নেতারা জানান, ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ বিধান করার পর ২০১১-১২ এবং ১৩ সাল পর্যন্ত ছয়টি সংশোধনী আনা হয়েছে। মামলার জন্য প্রতি জেলায় ট্রাইব্যুনাল এবং আপিল ট্রাইব্যুনাল আকৃতি করা হয়। বিধান অনুযায়ী রায়ের ৪৫ দিনের মধ্যে আবেদন করা বাধ্যতামূলক। আপিল ট্রাইব্যুনালের রায়ই চূড়ান্ত। রায়ের ৪৫ দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসনকে জমি বুঝিয়ে দেওয়ার কথাও আইনে উল্লেখ আছে।

পরিষদের নেতাদের অভিযোগ, রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে আইন করার পর ট্রাইব্যুনালে বিচার আরম্ভ হয়েছে। এই ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছার কোনো কমতি নেই; তা সত্ত্বেও জেলা প্রশাসন ও আমলারা আইন বাস্তবায়নে আসল অন্তরায় হিসেবে কাজ করছেন বলা হয় নালিশ তাদের। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা জেলা প্রশাসনের হাতে জিম্মি।  

২১ জেলায় অর্পিত সম্পত্তি আইনে মামলা

ক. অর্পিত প্রতিপত্তি প্রত্যর্পণ আইনের আওতায় সম্পত্তি ফেরত পেতে ২১ জেলার ট্রাইব্যুনালে মোট ৬৪ হাজার ৭৩টি আবেদন জমা পড়ে। নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে ২৬ হাজার ১২৩টি। ট্রাইব্যুনাল থেকে রায় হয়ে গিয়েছে ৪০ অংশ আবেদনের।

খ. ট্রাইব্যুনাল হতে নিষ্পত্তি হওয়া ২৬ হাজারের বেশি আবেদনের ভিতরে আপিল ট্রাইব্যুনালের আবেদন দায়ের করা হয়েছে হাজার ৯৪টি। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালের রায়ে সংক্ষুব্ধদের ভিতরে ১৯ ভাগ আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করেন। এর সেরা কারণ হলো, ২১ জেলায় অর্পিত সম্পত্তি আইনে মামলা ভাগের বেশিরভাগই ঐশ্বর্য ফেরত পেতে আবেদন করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ট্রাইব্যুনালের রায় তাদের বিপক্ষে গেছে।

ঐক্য পরিষদের পক্ষ হতে এইরকম জানা গেছে, ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিপক্ষে অ্যাপ্লাই দায়ের করার সময়সীমা ৪৫ দিন। অর্ধেকের বেশি ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের রায় সরকারের বিপক্ষে গেলে জেলা প্রশাসন নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে আপিল না করে কালক্ষেপণের পথ বেছে নিচ্ছে। ফলে নির্ধারিত সময়সীমার ভিতরে ধন প্রত্যর্পণ দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

‘খ’-তে  আপিল ট্রাইব্যুনালে ৫ হাজার ৯৪টি আবেদনের ভিতরে নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে ২ হাজার ৭৬৮টি। অর্থাৎ আপিল আবেদনের ৫৪ অংশ নিষ্পত্তি হয়েছে। অথচ আপিল ট্রাইব্যুনাল দিয়ে নিষ্পত্তিকৃত ২ হাজার ৭৬৮টি আবেদনের মাত্র ৫৪৮টি অর্থাৎ ১৯ অংশ সম্পত্তি জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর মেম্বার কাজল দেবনাথ কালবেলাকে বলেন, ২১ জেলার পরিসংখ্যানের দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হচ্ছে সরকারের বিপক্ষে রায় গেলে জেলা প্রশাসন একদিকে আইনে নির্ধারিত সময়সীমা ৪৫ দিন তো নয়ই, বছরের পর বছর আপিল দায়ের না করে কালক্ষেপণ করছে। অন্যদিকে আপিল ট্রাইব্যুনালের চূড়ান্ত রায়ের ৪৫ দিনের মধ্যে বিত্ত প্রত্যর্পণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও নানা বাহানা তুলে তা বাস্তবায়নে অকারণে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। এতে ভুক্তভোগীরা আইনের সুফল হতে বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও মনে করেন তিনি। 

২০১৩ সালে বিধানের সর্বশেষ সংশোধনীর পর অর্পিত বিত্ত প্রত্যর্পণ আইনে ভূমি-সংক্রান্ত মালিকানার জটিলতা ৯০ অংশ নিরসন করা পসিবল উল্লেখ করে কাজল দেবনাথ বলেন, আমলাতন্ত্র এবং মন্ত্রণালয়ের কারসাজিতে দিন দিন মানুষ ভোগান্তির ভিতরে রয়েছে। আদালতের রায়ের পর ভুক্তভোগীদের উদাহরণসরূপ ঘোরানো হচ্ছে, তেমনি জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে আপত্তিকর মন্তব্য করা হচ্ছে, যা সত্যিই দুঃখজনক। তা সত্ত্বেও বিধান করা এবং নিয়মের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর শতভাগ সদিচ্ছা বিদ্যমান বলা হয়ে থাকে আমরা আস্থা করি। তা সত্ত্বেও জেলা প্রশাসনের কারণে নিয়মের সুফল পাচ্ছেন না কমন মানুষ।

আইনের খেলাপ ঘটিয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে মালিকদের জমি বুঝিয়ে না দেওয়া প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না কালবেলাকে বলেন, রায়ের পরও বৈধ দাবিদারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কৃষিখেত বুঝিয়ে না দেওয়ায় অভিযোগ বিস্তর। এর ফলে নিয়মের টার্গেট পুরোপুরি সফল হচ্ছে না। সরকারের সৎ উদ্দেশ্যও ব্যাহত হচ্ছে।

আদালতের রায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়ম অনুসারে বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন যদি ভূমি বুঝিয়ে না দ্বারা এভাবে বৈধ দাবিদারদের ঘোরাতে থাকে তাহলে আদালত অবমাননার মামলা করার জন্য হবে। ভিকটিমরা বিচারালয় অবমাননার মামলা করলে তখন জেলা প্রশাসন আদালতের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য।

জানতে চাইলে মানবাধিকার নেত্রী খুশী কবির কালবেলাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা অনুসারে আইন হলো। অর্পিত সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার জন্য ট্রাইব্যুনাল হয়েছে। কিন্তু জেলা প্রশাসন রায় মানছে না। জমি বুঝিয়ে দিচ্ছে না। তারা কি আইন এবং দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে—এমন প্রশ্ন রেখে উনি বলেন, ২৩-০৩-১৯৭৪ এর পর আর কোনো সম্পত্তি নতুন করে অর্পিত ঘোষণা করা যাবে না, তার পরও দেখা গেল পরবর্তী সময়ে ডিসিরা এ আইনে প্রচুর ঐশ্বর্য নথিভুক্ত করে ফেলে।

তিনি বলেন, সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেও স্থানীয় প্রশাসন নিজেদের হাতে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য চায়, এমনকি ক্ষমতা দেখাতে চায়। তারা রায় বাস্তবায়ন না করে আদালতকে যেমন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন, তেমনি সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারকেও তোয়াক্কা করছেন না। এই অবস্থা চলতে থাকে তাহলে দেশকে নির্ভুল ধারায় নিয়ে যাওয়া সত্যিই উদ্বেগজনক হবে।

ফরিদপুরের ভুক্তভোগী উদ্ভাসিত সরকার কালবেলাকে জানান, আমরা তিন ভাই ও মা মিলে অর্পিত বিত্ত আইনে ৩৮টি মামলা করেছি। এর মধ্যে ২৩টি মামলার চূড়ান্ত রায় হলেও পাঁচ মামলার ভূমি বুঝে পেয়েছি। অবশিষ্ট রায়গুলো বাস্তবায়নে ৩ থেকে ৬ বছর ধরে ঘোরানো হচ্ছে। জেলা প্রশাসক ও এসিল্যান্ডের কাছে বেশকিছু মামলার রায় বাস্তবায়নে দিনের পর দিন ঘুরতে হলো জানিয়ে তিনি বলেন, নানা উপায়ের কথা বলা হয় কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও আমাদের অৰ্পণ করা জমিতে রাষ্ট্রের পর্যাপ্ত ইন্সটিটিউট প্রস্তুত হয়েছে।

ফরিদপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত বর্ষের ২৮ আগস্ট পর্যন্ত নয় উপজেলায় এ আইনে ২ হাজার ৩২৬টি মামলা হয়েছে। এর ভিতরে রাষ্ট্রের পক্ষে গেছে ১ হাজার ৯৬টি, বিপক্ষে গেছে ৫৫২টি। পেন্ডিং মামলার পরিমান ৬৭৮টি বলা হয় জানা গেছে।

ঝিনাইদহের নিমাই  কুণ্ডর ছেলে নিতিষ কুণ্ড কালবেলাকে বলেন, ৩ একর ১৪ শতক জমি ফেরত পেতে আমার বাবা অর্পিত সম্পত্তি আইনে মামলা করেন। ১৭ সালের রায়ের পর ধন ফেরত চেয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর আপিল করি। সেই সময় দায়িত্বরত এডিসি-রাজস্ব আমার বাবার সাথে পীড়ন করে বলেন, ‘সম্পত্তি ফেরত দেব না। তুই মরে যাবি, তোর ছেলে মরে যাবে; তবু সম্পত্তি পাবি না। হিন্দু ডিসি রয়েছে গিয়ে নালিশ কর। অভিযোগ করে বালিশ নিয়ে যা।’ এই আচরণে জন্মদাতা খুবই কষ্ট পান। এখনো আমরা জমি ফেরত পাইনি।

ঐক্য পরিষদের নেতারা জানান, শীর্ষ আদালতের রায় অনুসারে ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চের পর অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত কোনো সম্পত্তিই আর অর্পিত হিসেবে  হবে না। অর্পিত ঐশ্বর্য বিধানের ১ম দিকের গেজেটে কবে ঐশ্বর্য অর্পিত হিসেবে ঘোষিত হয়েছে, সেই তারিখ উল্লেখ করা হতো।

এক পর্যায়ে ২৩-০৩-১৯৭৪ সালের বিষয়টিকে আড়াল করে আমলাদের কূটকৌশলে পরের গেজেটে এ তারিখের কলাম তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে আইনের পুরোপুরি সুবিধা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। সেইসঙ্গে জমি অর্পিত করার রেকর্ড বের করার জন্য সময়ক্ষেপণ হচ্ছে।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow