যেমন আছেন টঙ্ক আন্দোলন ও হাজং বিদ্রোহের সাক্ষী কুমুদিনী হাজং

পাকিস্তানি জুলুম বৈষম্য, নিপীড়ন, ১৯৬৪ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মহান স্বাধীনতা আন্দোলন তিনি দেখেছেন 

Dec 13, 2022 - 13:50
Dec 13, 2022 - 16:52
 0
যেমন আছেন  টঙ্ক আন্দোলন ও হাজং বিদ্রোহের সাক্ষী কুমুদিনী হাজং
বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের পাদদেশে হাজং আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস : সংগ্রহীত ছবি

 

বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের পাদদেশে হাজং আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস। সনাতন ধর্মাশ্রয়ী হাজং আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন বেশি তৎকাল থেকেই তান্ত্রিকতাবাদে বিশ্বাসী। যুগযুগ ধরে কৃষিই হাজংদের শুধুমাত্র পেশা। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে হাজং সম্প্রদায়কে সুসং জমিদারদের হস্তি ধরার কাজে নিয়োজিত করায় তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ইতিহাসে সে আন্দোলন ‘হাতিখেদা বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। তেমনি নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশে সোমেশ্বরী নদীর পশ্চিম তীরে বহেরাতলী গ্রামে এক কৃষিজীবী হাজং পরিবারে কুমুদিনী হাজং-এর জন্ম। কুমুদিনীর জন্মদাতা অতিথ শশাঙ্ক একজন হাতিখেদা বিদ্রোহী ছিলেন। কুমুদিনী হাজং এর জন্ম সন তিনি নিজেও বলতে পারেন না। কিন্তু তিনি তাঁর বয়স আন্দাজ করেন ৭৩/৭৪ বছর।

কুমুদিনী হাজং এর জন্মের দু’বছর পরেই বাপ অতিথ  রায় হাজং এবং মা জনুমনি হাজং মারা যান। মামার কোলে পিঠেই বড় হন কুমুদিনী হাজং (অনেক ট্রাই করেও কুমুদিনী হাজং মামার নাম স্মরণ করতে পারেন নি। তিনি জানান মামার নাম ধরে কেউ ডাকতো না বলেই মামার নাম মনে নেই)৷ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার না থাকায় সে সময় বহেরাতলী গ্রামসহ পাশ্ববর্তী এলাকায় কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। সে কারণেই কুমুদিনী হাজং কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেননি।

ব্রিটিশ বিরোধী ঐতিহাসিক টংক আন্দোলন এবং হাজং বিদ্রোহের সাক্ষী কুমুদিনী হাজং ২য় বিশ্ব যুদ্ধ  পরবর্তী টংক আন্দোলন, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানি জুলুম বৈষম্য, নিপীড়ন, ১৯৬৪ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মহান স্বাধীনতা আন্দোলন তিনি দেখেছেন 

বাংলা একাডেমি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যে সাতজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ-২০১৯ প্রদান করেছে তার মধ্যে কুমুদিনী হাজং একজন। সমাজসেবা কাজে অবদানের জন্য তিনি এ ফেলোশিপটি পেয়েছেন। আমরা আরো আগেই রাষ্ট্র থেকে এই জীবন্ত কিংবদন্তির জন্য কোন সম্মানের প্রত্যাশা করেছিলাম। যদিও এর আগে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়া থেকে তিনি কিছু পুরস্কার এবং সম্মানী পদক পেয়েছেন যেটার মধ্যে রয়েছে- অনন্যা শীর্ষদশ (২০০৩), ড. আহমদ শরীফ স্মারক (২০০৫), কমরেড মনি সিংহ  পদক (২০০৭), সিধু-কানহু-ফুলমণি পদক (২০১০), জলসিঁড়ি (২০১৪), হাজং জাতীয় পুরস্কার (২০১৮) ইত্যাদি।

টঙ্ক আন্দোলন কি ?

টঙ্ক মানে ধান কড়ারী খাজনা। হোক বা না হোক কড়ার মতো ধান দিতে হবে। টঙ্ক জমির ওপর কৃষকদের কোনো স্বত্ব ছিল না। জমিদাররা ইচ্ছে মত   করতো। লুটে নিতো ফসল। জঙ্গলে পরিষ্কার করে যে কৃষকরা তৈরি করেছিলো ফসলি ভূমি সেই কৃষকদেরকেই বুদ্ধি করে ঠকিয়ে ফসল লুটে নিতো বৃটিশদের দালাল হিসেবে অবগত জমিদাররা। আর এর বিরুদ্ধেই গড়ে উঠেছিলো  আন্দোলন।


১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি। গ্রামের সব কৃষিজীবী মাঠে কাজ করতে গিয়েছে। নিরব, শান্ত সবুজ গ্রাম। শিশুরা বাড়ির অঙ্গনে খেলছে। গ্রামে চলে আসে ব্রিটিশ পুলিশ দল। টংক আন্দোলনকারীদের খোঁজ করার নামে আন্দোলনকারী কৃষিজীবী হাজং নেতা কুমুদিনীর জামাই লংকেশ্বর হাজংকে কক্ষে না পেয়ে নববধু কুমুদিনীকে জোর করে টেনেপিঁঁঁছড়ে নিয়ে চলে দুর্গাপুর পুলিশ ফাঁড়ির দিকে। এ বার্তা পেয়ে বহেরাতলী গ্রামের রাশিমনি হাজং শতাধিক নারী পুরুষ নিয়ে দেশী দা, ঝাড়–, বল্লম, লাঠি, তীর ধনুকসহ সুমেশ্বরী নদীর তীরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কুমুদিনীকে ত্যাগ দিতে বলেন। কিন্তু পুলিশ কোন কথাই না শুনে টেনেপিঁছড়ে নববধু কুমুদিনীকে দুর্গাপুরের সেনাছাড়নির দিকে নিয়ে চলে। রাশমনি দা দিয়ে এলোপাতারি কুপাতে থাকেন। তিনি একজন পুলিশকে দা দ্বারা কুপিয়ে মেরে ফেলেন। পুশিলের গুলিতে রাশিমনি হাজং নিহত হন। সহযোদ্ধা সুরেন্দ্র হাজং সেই পুলিশকে কুপিয়ে মেরে ফেলেন। অতঃপর পুলিশের গুলিতে ২২ মানব হাজং কৃষক নারীপুরুষ মারা যায়। বেগতিক দেখে পুলিশ চলে যায়। গ্রামবাসী ভবিষ্যতে আরো বৃহৎ হামলার ডরে লাশগুলো সুমেশ্বরী নদীতে ভাসিয়ে দেয়। পরদিন ব্রিটিশ পুলিশ বহেরাতলী গ্রামে তান্ডব চালায় ও গ্রামকে তছনছ করে ফেলে।

 
কেমন রয়েছেন কুমুদিনী ?

কুমুদিনীর স্বামী মারা গেছেন ২০০০ সালে। ১৯৫০ সালে টংক প্রথা বিলুপ্তির পর হাজংদের উপর জুলুম অত্যাচার নেমে আসে। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ভারতে চলে যায়। স্বাধীনতার পর ফিরে এসে দেখে তার ৪ আড়া ভূমি আধিপত্য হয়ে গেছে । যা আজও উদ্ধা করতে পারে নাই।


কুমিদিনী হাজং টংক প্রথা বিরোধী যুদ্ধে পরাজিত হন নাই। পরাজিত হয়েছেন বার্ধক্যের কাছে। পরাজিত হয়েছেন নিজের জমি উদ্ধারের সংগ্রামে। উনি আমাদের নিকট মাহাত্ম্য এবং গৌরবের সংগ্রামী মুখ। প্রেরণার উৎস। আমাদের নেত্রকোনা তথা বাংলাদের আদিবাসী নারী তথা  নারী সমাজের প্রতিকৃত।

টংক আন্দোলনে হাজং সম্প্রদায়ের অনেক ত্যাগ আছে। তারা ব্রিটিশদের হাতে জুলিমের শিকার হয়েছিল। এই অবদানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে কুমুদিনীকে একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক দেওয়ার দাবি জানান উনি ও তার এলাকা বাসি । 

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow