দিনে মানলেও রাতে উধাও সব নির্দেশনা

Apr 8, 2023 - 11:03
 0
দিনে মানলেও রাতে উধাও সব নির্দেশনা
সংগ্রহীত ছবি

রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় ধসে যাওয়া ভবনটি কোনো রকমে দাঁড়িয়ে আছে লোহার ঠেকনায় ভর করে। ভবনটির পুরোপুরি ধস ঠেকাতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, ভবনটির সামনে অন্তত ২৬ ফুট পর্যন্ত কংক্রিট বা স্টিল রোড ব্যারিয়ার দিয়ে রাখতে হবে। রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত সামনের সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রাখতে হবে। তবে এর কিছুই মানা হচ্ছে।

গত কয়েকদিন ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পণ্যবাহী ভারী যান চলাচল করছে ওই ভবনের সামনে দিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে কম্পনের সৃষ্টি হয়ে ফের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। রাজউকের অন্যান্য নির্দেশনা না মানায় বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রাও।

গত ৭ মার্চ বিকেল পৌনে ৫টার দিকে গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়ার অদূরে সিদ্দিকবাজারে কুইন্স স্যানিটারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত সাততলা ভবনে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ভবনটির বেজমেন্ট, প্রথম ও দ্বিতীয় তলা অনেকটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এ ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়। বিস্ফোরণের পর ভবনটির ব্যবহার উপযোগিতার বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ছয় সদস্যের কমিটি করে রাজউক। ওই কমিটি ভবনটি পরিদর্শন শেষে তাদের প্রতিবেদনে সুপারিশ দেয়।

সুপারিশে বলা হয়, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংলগ্ন স্থাপনাগুলো এবং রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহন ও পথচারীদের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে ক্ষতিগ্রস্ত বিম-কলামগুলো অতিদ্রুত ঠেকনা দিতে হবে। একই সঙ্গে ওই ভবনের সামনের ফুটপাতসহ রাস্তার দিকে ২৬ ফুট পর্যন্ত জায়গা কংক্রিট বা স্টিল রোড ব্যারিয়ার দিয়ে কর্ডন করে রাখতে হবে। ভবনের সামনের রাস্তায় সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বাসসহ অন্যান্য হালকা যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া যেতে পারে। তবে রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ওই রাস্তায় সব যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে হবে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবনের ২৪টি কলামের মধ্যে ৯টি, বেজমেন্ট, গ্রাউন্ড ফ্লোর, বিম ও পাশের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এজন্য মালিকপক্ষকে ৪৫ দিনের মধ্যে কোনো বেসরকারি বা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান দিয়ে ভবনটি পরিদর্শন করিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়। পরে প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ করার কথা।

সরেজমিন দেখা যায়, এক মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতে পারেনি ভবন মালিকরা। পুলিশও ওই ভবনের সামনের সড়কে ভারী যান চলাচল বন্ধ করেনি। ভবনের সামনে ফুটপাত পর্যন্ত রশি দিয়ে কর্ডন করে রাখা হলেও যে কেউ চাইলেই ভেতরে প্রবেশ করতে পারছে। তবে ভেতরে কেউ থাকছে না। ঝুঁকি জেনেও দুই পাশের দোকান চালু রয়েছে। ভবনটির সামনে রাতদিনই রাখা হচ্ছে ট্রাকসহ নানা পণ্যের গাড়ি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুইন স্যানিটারি মার্কেট ভবনের দুই মালিক এখনো কারাগারে। তাই রাজউকের নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

ধসে যাওয়া ভবনের পাশে ‘রমজান এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি স্যানিটারির দোকান রয়েছে। ধসের পর সেটি বন্ধ থাকলেও ফের চালু করা হয়েছে। ওই দোকানের ব্যবস্থাপক মো. নিজাম কালবেলাকে বলেন, ‘বিস্ফোরণের পর প্রথম দিকে তো দেখেছি রাতে এই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হতো। যদি নির্দেশনা অমান্য করে ভারী ট্রাক চলে তাহলে তো যে কোনো সময় আবার দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এটা আমাদের জন্য ভয়ের কারণ।’


ক্যাফে কুইন ভবনের অদূরে চারতলা একটি ভবনে থাকেন স্যানিটারি দোকানের কর্মী আব্দুল লতিফ। তিনি জানান, কাজ শেষে মার্কেটের উপরে থাকেন তারা। রাতভর রাস্তায় ভারী ট্রাক চলে। কেঁপে ওঠে আশপাশের এলাকা। আতঙ্কে ঠিকঠাক ঘুমাতে পারেন না তারা।

গত মঙ্গলবার রাত ৩টার ক্যাফে কুইন ভবনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের সামনের রাস্তা তখনো খোলা। চলছে মালবাহী ভারী যান। টহলরত পুলিশ জানায়, রাস্তা খোলা বা বন্ধ রাখার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের, এ বিষয়ে তারা কিছু জানেন না।

রাজউকের তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন ওই এলাকার অথরাইজড অফিসার প্রকৌশলী রংগন মণ্ডল। তিনি কালবেলাকে বলেন, আমরা ভবনটিকে লোহার খুঁটি দিয়ে ঠেকনা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ভবনটির কিছু কলাম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এই মুহূর্তে ভারী যানবাহন চলাচল করলে ভবনে ভাইব্রেশন তৈরি হবে। এতে যে কোনো সময় আবারও বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। রাজউকের পক্ষ থেকে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে এ নির্দেশনা দেওয়া আছে। এটি বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট থানার।

অবশ্য বংশাল থানার ওসি মজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভবনটির সামনের সড়কে ভারী যান চলার বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘সিদ্দিকবাজারের ঘটনা সিটিটিসি দেখছে। আমরা এ ব্যাপারে জানি না।’

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিদ্দিকবাজার ভবন বিস্ফোরণের ঘটনায় বংশাল থানায় দুটি মামলার মধ্যে অবহেলার অভিযোগে মৃত্যুর মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তারা মনে করছেন, তিতাসের গ্যাস জমে ওই ভবনটিতে বিস্ফোরণ হয়ে ধসে পড়েছে। ভবনটি ধসের পেছনে তিতাস, রাজউক ও ভবনের মালিকের অবহেলাও রয়েছে।

ওই মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল বিভাগের প্রধান এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, তারা ঘটনাটি তদন্ত করছেন। এরই মধ্যে তিতাসের প্রতিনিধিদের নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow