হালখাতা জৌলুস হারানোয় ব্যবসায়ীদের শঙ্কা

বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উৎসব পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ। আর বর্ষবরণের অন্যতম উৎসব হলো ঐতিহ্যবাহী হালখাতা।এদিন ব্যবসায়ীরা লাল মলাটের নতুন খাতায় নতুন বছরের হিসেব শুরু করেন। বিশেষ করে তারা এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। কারণ, বছরের প্রথম দিনটিতে ব্যবসায়ী-ক্রেতাদের মধ্যে দেনা-পাওনার হিসেব হয়। দুপক্ষের মধ্যে বিশ্বাস, আস্থা ও গভীর সম্পর্কের মূল ভিত্তি এই হালখাতা।

Apr 14, 2023 - 10:29
 0
হালখাতা জৌলুস হারানোয় ব্যবসায়ীদের শঙ্কা
সংগ্রহীত ছবি

এবার ঈদের প্রাক্কালে পহেলা বৈশাখ হওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। বিশেষ করে, করোনা কাটিয়ে এবার উন্মুক্ত পরিবেশে দেশের মানুষ পহেলা বৈশাখ এবং ঈদের কেনাকাটা করতে পারছে। যা হালখাতার উৎসবকে আরও জাঁকজমকপূর্ণ করে তুলছে। তবে স্বর্ণের অস্বাভাবিক দামের কারণে স্বর্ণ ব্যবসায় ভাটা চলছে। তা সত্ত্বেও প্রতিবারের মতো এবারও তাঁতীবাজার ও শাঁখারীবাজারের জুয়েলার্স ও অলংকার তৈরির দোকানগুলোতে বর্ণিল সাজে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, বাংলা সন চালুর পর থেকে নববর্ষ উদযাপনে নানা আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পয়লা বৈশাখের দ্বিতীয় বৃহৎ অনুষ্ঠান ছিল হালখাতা। অনুষ্ঠানটি করতেন ব্যবসায়ীরা। কৃষিভিত্তিক সমাজ ফসল বিক্রি করে হাতে নগদ পয়সা পেত। পাট ছিল নগদ পয়সার উৎস। ফসলের মৌসুমে ফলন বিক্রির টাকা হাতে না এলে কৃষকসহ প্রায় কেউই নগদ টাকার মুখ খুব একটা দেখতেন না। ফলে সারা বছর বাকিতে জিনিসপত্র না কিনে তাদের কোনো উপায় ছিল না। পয়লা বৈশাখের হালখাতা অনুষ্ঠানে তারা দোকানিদের বাকির টাকা মিটিয়ে দিতেন। অনেকে আংশিক পরিশোধ করেও নতুন বছরের খাতা খুলতেন। তারা পণ্য বাকিতে বিক্রি করতেন। সবাই সবার পরিচিত ছিলন বলে বাকি দেওয়ার বিষয়ে দ্বিধা থাকত না। টাকা কেউ মেরে দেবে না বলেই বিশ্বাস করতেন তারা। এর আগে পয়লা বৈশাখে নবাব ও জমিদারেরা পুণ্যাহ উৎসব পালন করতেন।

কিন্তু এখন দোকানগুলোয় আগের মতো এমন চিত্র দেখা যায় না। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হাতে লেখা খাতা থেকে অনেককে নিষ্কৃতি দিয়েছে। ১০/১৫ বছর আগেও আড়ৎ ও দোকানগুলোতে হালখাতার যে জাঁকজমক অনুষ্ঠান দেখা যেত, তা এখন আর নেই। আগে ব্যবসায়ীরা মুখের কথায় বিশ্বাস করে লাখ লাখ টাকা বাকি দিতেন। তার বেশিরভাগই উসুল হতো হালখাতার দিনে। এখন লেনদেনটা অনেকে ব্যাংকের মাধ্যমে চুকিয়ে নেন। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে আয়োজনের ধরণ। সেই দিন আর নেই। নেই সেই হালখাতা উৎসবও। অথচ সার্বজনীন উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ ছিল বাংলা নববর্ষের প্রাণ। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যর এই প্রাণের হালখাতা উৎসব যেন আজ আধুনিক যুগের অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির পৃথিবীর কাছে ধোপে টিকতে পারছে না।

বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার, তাঁতিবাজার ও শ্যামবাজারের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরেজমিন ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, রোজা ও ঈদ চলে আসায় এ বছর পয়লা বৈশাখ নিয়ে আলাদা কোনো আয়োজন করেনি পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা। অথচ এ সময় ব্যবসায়ীরা দোকান-পাট পরিষ্কার, রং করাসহ বিভিন্ন সাজসজ্জা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এ বছর সেরকম কিছু দেখা না গেলেও দুয়েকটি দোকানে রঙিন হাঁড়ি, সোলার ফুল, রঙিন কুলা, ঘটের দেখা মিলেছে। ব্যবসায়ীদের মনে নেই কোনো উৎসবের আমেজ। টালি খাতা, পাটি ব্যবসায়ীদের হাঁক ডাকও চোখে পড়েনি। হালখাতা উপলক্ষে ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ পত্র ছাপানো, মিষ্টির অর্ডারও কমে গেছে। মোট কথা হালখাতা নিয়ে কোনো উৎসবের আমেজ নেই এ বাজারগুলোয়। মূলত ঐতিহ্য রক্ষায় নামেমাত্র হালখাতা করবেন ব্যবসায়ীরা।

বিগত দুইবছর করোনা মহামারির কারণে ঠিকমতো হালখাতা অনুষ্ঠান করতে পারেননি পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা। এবার তাই রোজার মধ্যেও বৈশাখের অনুষ্ঠান ও হালখাতার অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আগে থেকে অন্যরকম আমেজ কাজ করছে ব্যবসায়ীদের মাঝে। 
বঙ্গাব্দ ১৪২৯ সালের বিদায় শেষে ১৪৩০ সালের আগমনী বার্তা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। পুরনো হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে ফেলার ধুম আয়োজন চলছে সর্বত্র। ঐতিহ্যগতভাবেই হালখাতা খুলে আর মিষ্টি বিতরণ করে বাংলা নববর্ষ পালন করে আসছেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না।
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটিকে ঘিরে বরাবরই রঙিন সাজে মেতে ওঠে পুরান ঢাকা। মোঘল সম্রাট আকবর বৈশাখকে প্রথম মাস ধরে বাংলা বছর গণনা চালু করার পর থেকেই পহেলা বৈশাখের প্রচলন শুরু হয়। এ দিন বছরের সব দেনা-পাওনা মিটিয়ে নতুন বছরের জন্য নতুন খাতা খোলেন ব্যবসায়ীরা। আনন্দ-আয়োজন আর আপ্যায়নে তা খোলা হয়ে থাকে। পুরান ঢাকার সদরঘাট, তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজারের জুয়েলার্স ও অলংকার তৈরির কারখানা, শ্যামবাজার, চকবাজার ও ইসলামপুরের কাপড়ের দোকানগুলোতে প্রতিবছরই হালখাতা হয়।
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা নতুনভাবে সাজিয়ে তুলছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ক্ষেত্র বিশেষে গ্রাহকদের হালখাতা অনুষ্ঠানের দাওয়াত প্রদানও সম্পন্ন হয়েছে। খুচরা ও পাইকারি ক্রেতা সাধারণ নিয়ে নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে বর্ষবরণে প্রস্তুত হয়েছেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা। প্রস্তুত হয়েছেন পুরান ঢাকার চকবাজার, তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, বাংলাবাজার, শ্যামবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ব্যবসায়ীরা। এ জন্য পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন, অনেকে আবার নানা রঙের বাতি ও ফুল দিয়ে সাজিয়ে তুলছেন।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সূত্রে জানা গেছে, বৈশাখের বাজারে দেশিয় বাঁশ, বেত, কাঠের তৈরি জিনিস, মাটির তৈজসপত্র, খেলনা, প্লাস্টিকের খেলনা, বিভিন্ন ধরনের মুড়ি-মুড়কি, নাড়ু বাজারেই বিকিকিনি হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। এর বাইরে আরও প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার অন্য পোশাক বিক্রি হয় বৈশাখী বাজারে। তাছাড়া ইলিশের বিকিকিনি হয় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার। একইভাবে মিষ্টির দোকানগুলোয় বিক্রি হয় ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার মিষ্টি। সবমিলিয়ে বৈশাখে কেবল পোশাক বিক্রিই হয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার।

বৈশাখী উৎসব ঘিরে আর্থিক লেনদেন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হয়। বাজারে বাড়ে টাকার প্রবাহ। চাঙা হয়ে ওঠে অর্থনীতি। এ সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো তাদের এটিএম, ক্রেডিট কার্ড ও ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবস্থায় অর্থের পর্যাপ্ত জোগান রাখে। প্রবাসীরা তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি রেমিট্যান্স পাঠায়। মোবাইল ব্যাংকিং ও পোস্ট অফিসের মাধ্যমেও লেনদেন বাড়ে।

উল্লেখ্য, সর্বজনীন উৎসব হিসেবে হালখাতা বাংলা নববর্ষের প্রাণ। ইতিহাস অনুযায়ী, ১৫৮৪ সালে সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর থেকেই এর প্রচলন হয়। পুরনো বছরের হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলা হয় যে খাতায় সেটিই হালখাতা। অতীতে জমিদারকে খাজনা দেওয়ার অনুষ্ঠান হিসেবে পুণ্যাহ প্রচলিত ছিল। বছরের প্রথম দিন প্রজারা সাধ্যমতো ভালো পোশাক পরে জমিদার বাড়িতে গিয়ে খাজনা পরিশোধ করতেন। তাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ায় পুণ্যাহ বিলুপ্ত হয়েছে।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow