ঈদের পরে আন্দোলনের আভাস হেফাজতের
কারাবন্দি নেতাকর্মী ও আলেম-ওলামাদের মুক্তির দাবিতে ঈদের পর কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে হেফাজতে ইসলাম। এমনটা ইঙ্গিত দিয়ে দলটির একাধিক নেতা বলেন, বিনা বিচারে দীর্ঘদিন আটক নেতাকর্মীদের ঈদের আগেই মুক্তি দিয়ে পরিবারের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগির সুযোগ দিন। অন্যথায় দেশের তৌহিদি জনতা মসজিদ, মাদ্রাসা ও ঘরে চুপচাপ বসে থাকবে না। এদিকে এ পরিস্থিতিতে হেফাজতের আঁতুড়ঘর বলে খ্যাত হাটহাজারী মাদ্রাসায় আজ যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সূত্রমতে, হেফাজতের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে ইফতার ও একান্ত বৈঠক করবেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হেফাজত নেতাদের সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল গত বছর ১৭ ডিসেম্বর। ওই সময় সংগঠনের মহাসচিবসহ ১১ জনের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তিনটি দাবি জানিয়েছিলেন। এর মধ্যে দুটিই ছিল আটক নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং সব মামলা প্রত্যাহারের। প্রধানমন্ত্রী দাবিগুলো দ্রুত পূরণের আশ্বাস দিয়েছিলেন বলে দাবি হেফাজতের। বৈঠকের পরদিনই মুক্তি পান হেফাজত নেতা আজিজুল হক ইসলামাবাদী। এ ঘটনাকে ‘বৈঠকের সুফল’ হিসেবে মনে করেছিল সংগঠনটি। পরে হেফাজতকর্মী জিয়াউর রহমান ফারুকীসহ বেশ কয়েকজন মুক্তি পায়। সম্প্রতি ‘শিশুবক্তা’ মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানি ও হেফাজত নেতা মুফতি আজহার উদ্দিনকে জামিন দিয়েছেন আদালত। আইনি প্রক্রিয়া শেষে শিগগির মুক্তি পেতে পারেন এই দুজন।
জানা গেছে, বৈঠকে কারাগারে আটক নেতাদের মুক্তির তালিকায় এক নম্বরে ছিল সংগঠনের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীর নাম। এরপর মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী, মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, মুফতি মাহমুদুল হাসান গুনবি, মাওলানা মামুনুল হক ও মুফতি হারুণ ইজহারের নাম। তবে, বৈঠকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আজিজুল ইসলামাবাদী মুক্তি পেলেও অন্যরা এখনো কারাগারে। সম্প্রতি হাইকোর্টের আদেশ লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠার পর সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এক মামলায় হারুণ ইজাহারের জামিননামাও বাতিল করেন চট্টগ্রামের একটি আদালত। আজিজুল হক ইসলামাবাদী মরহুম আহমদ শফী ও জুনাইদ বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও মুখপাত্র ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা ছিল। প্রতিটি মামলায় তিনি জামিন পেয়েছেন। হেফাজতের সাবেক শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পাদক হারুণ ইজহার বহুল আলোচিত মুফতি ইজহারুল ইসলামের ছেলে। মুফতি ইজহার চট্টগ্রামের লালখানবাজার জামেয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। বাবা-ছেলে দুজনই জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে সমালোচিত।
হেফাজত নেতারা জানান, প্রথম দুটি দাবির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে বৈঠকে উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। আর হেফাজত নেতাদের বলেন, মামলার বিষয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে।
কারাবন্দি নেতাদের ঈদের আগেই মুক্তির দাবি জানিয়ে গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে দলটির কঠোর বিবৃতির এক দিন পর আজ হাটহাজারী যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। হেফাজতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হাটহাজারী মাদ্রাসায় আজ ইফতার করবেন তিনি। বিষয়টি কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর মুহাম্মদ ইদ্রিস।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের চার মাস পরও দাবি পুরোপুরি পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছে হেফাজত। ঈদের আগেই কারাবন্দি নেতাকর্মী ও আলেমদের মুক্তি চেয়েছে সংগঠনটি। বিশেষ করে তারা মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী, মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, মুফতি মাহমুদুল হাসান গুনবি, মাওলানা মামুনুল হক, মুফতি হারুণ ইজহার প্রমুখের মুক্তির দাবি জানায়।
সরকারকে উদ্দেশ করে হেফাজতের মহাসচিব শায়েখ সাজেদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, তাকওয়ার মাস রমজান এবং আল্লাহকে ভয় করুন। কারাবন্দি আলেম-ওলামাদের আর কষ্ট দেবেন না। সবাইকে ঈদের আগেই মুক্তি দিন। তারা মুক্ত হলে আপনারাও মুক্ত। দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়ে হেফাজত মহাসচিব বলেন, কর্মসূচি দিতে আমাদের বাধ্য করবেন না। তৌহিদি জনতা মাঠে নামলে পরিস্থিতি জটিলতর হবে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, বিনা বিচারে বন্দি করে রাখাটা বিচারবহির্ভূত শাস্তি। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, কোনো বাহিনী বা সরকার যেই করুক না কেন তা অপরাধ।
ঈদের পরে কর্মসূচির ইঙ্গিত দিয়ে হেফাজতের সিনিয়র নায়েবে আমির ও হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া বলেন, এমনিতেই নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামে সাধারণ মানুষ পেট ভরে খেতে পারছেন না! অন্যদিকে ক্ষোভ-অসন্তোষ বাসা বেঁধেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। পরিস্থিতি দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় দেশের ইসলাম অনুরাগী তৌহিদি জনতাকে শান্ত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
তবে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস পূরণ হবে বলে এখনো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুহিউদ্দিন রব্বানী। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ। দাবি-দাওয়া পূরণের বিষয়টি তিনি মন থেকে উপলব্ধি করেছেন বলে মনে করি। বৈঠকে নেতাকর্মী ও আলেমা-ওলামাদের মুক্তির বিষয়টি তিনিই প্রধানমন্ত্রীর নজরে এনেছিলেন জানিয়ে বলেন, বাকি নেতাদের মুক্তির অপেক্ষায় আছি। আশা করি প্রধানমন্ত্রী নিরাশ করবেন না যাতে আন্দোলনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর প্রতিহত করার ডাক দিয়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ঢাকা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের কয়েকটি স্থানে সংঘাতে জড়ায় হেফাজত। এসব ঘটনায় একাধিক মামলা হয়। এতে দেশব্যাপী হেফাজতের কয়েকশ নেতাকর্মী ও আলেমকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে অভিযোগ সংগঠনটির।
What's Your Reaction?