‘আসল পরীক্ষা’ শুরু মেসির

দুই ‘ডামিম্যান’কে কাটালেন, গুণিতক চিহ্নে  দুই জনের ফাঁক দিয়ে এক লাফে বেরিয়ে গেলেন চোখের পলকে, এরপর দুম করে শট নিলেন লিওনেল মেসি। মুহূর্তেই ছোট পোস্টের জালে লুটোপুটি খেল বল। প্রস্তুতির এ ছবি তিনি মাঠের লড়াইয়ে, আসল ক্যানভাসে আঁকেন হরহামেশাই, জাদুকরী বাঁ পায়ে বেশি, ‘দুর্বল’ ডান পায়ে কম, এ যা। 

কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন নম্বর মাঠে শুক্রবার সন্ধ্যায় অনুশীলনে মেসির করা ওই ‘গোল’ স্রেফ প্রস্তুতি নয়। সেখানে মিশে থাকল কাতার বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে আর্জেন্টিনাকে টেনে নেওয়ার বার্তা, ১৯৮৬ সালের পর হতে আলবিসেলেস্তাদের চলা বিশ্বকাপের হাহাকার দূর করার মরিয়া আকাঙ্ক্ষা, ব্যর্থতার বৃত্ত ভাঙার প্রত্যয়। 

মেসি অনুশীলনে নামেন নির্ধারিত সময়ের মিনিট পাঁচেক পরে। তার প্রথমে মাঠে আসেন আক্রমণভাগের সতীর্থ লাউতারো মার্তিনেস, পাওলো দিবালা, হুলিয়ান আলভারেসরা। তারা এসে মাঠের উত্তর কোণে চালু করেন অনুশীলন। এই পর্বে অবশ্য শুটিং নয়, পাসিং ও বলের নিয়ন্ত্রণ রাখার দিকে মনোযোগ দিতে দেখা যায় আক্রমণভাগের খেলোয়াড়সহ বাকিদের।

একটু পর কোচ লিওনেল স্কালোনির ডেকে আনে সবাই মাঝমাঠে আসার সময় যোগ দেন মেসি। তিনি আর্জেন্টিনার অধিনায়ক, আক্রমণভাগের প্রাণভোমরা, দলকে সামনে থেকে এগিয়ে নেওয়ার মহাভার তার কাঁধে, তা সত্ত্বেও মধ্যমাঠের বৃত্তে আসার সময় তিনি কিনা সবার পেছনে! এ তথ্যে অবশ্য মেসি ভক্তদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। বাকিটা সময় তিনি সামনে থেকেই সবকিছু করেছেন, যেমনটা করেন মাঠের লড়াইয়ে। 

গ্রুপ পর্বের পথচলায় মেসি মিষ্টি-তেতো দুই রকম স্বাদই পেয়েছেন। অধিনায়ক হিসেবে ডরের দোলুনিতে দুলেছেন, আবার স্বস্তি ও ‘প্রথম’ লক্ষ্য পূরণের উচ্ছ্বাসে মেতেছেন। ফরোয়ার্ড হিসেবে গোল করেছেন আবার পুড়েছেন পেনাল্টি মিস করার হতাশায়ও। 

পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার সবশেষ ম্যাচে স্পট কিক থেকে দলকে এগিয়ে নিতে অসমর্থ হন মেসি। তবে অধিনায়কের না পারা আড়াল হয়ে যায় দুই তরুণ আলেক্সিস মাক আলিস্তের ও আরভারেসের গোলে। ভয়ের কালো মেঘ সরিয়ে আর্জেন্টিনা পাড় হয়ে যায় গ্রুপ পর্বের বৈতরণী। সেটাও ‘সি’ গ্রুপের সেরা হয়ে। 

সৌদি আরবের বিরুদ্ধে দশম মিনিটে পেনাল্টি হতে লক্ষ্যভেদ করেছিলেন মেসি, তবুও পাঁচ মিনিটের মরু  কোণঠাসা হয়ে পড়ে আর্জেন্টিনা। দুই গোল হজম করে ২-১ ব্যবধানে হেরে কাতার বিশ্বকাপ আরম্ভ করে লিওনেল স্কালোনির দল। টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার আত্মবিশ্বাসের কঠিন দেয়ালে যেন চিড় ধরে। গ্রুপ পর্বে থেকে ছিটকে যাওয়ার শঙ্কাও উঁকি দেওয়ার জন্য থাকে দুইবারের জগৎ চ্যাম্পিয়নদের আকাশে। 

মেক্সিকোর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেও গোলে জন্য হাসফাঁস করতে থাকে আকাশি-সাদা জার্সিধারীরা। যথারীতি ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হন মেসি। ৬৪তম মিনিটে ম্যাচের ‘ডেডলক’ ৩৫ বছর বয়সী এ ফরোয়ার্ড খোলেন দূরপাল্লার মুগ্ধতা ছড়ানো শটে। পরে ৮৭তম মিনিটে ফের্নান্দেসের গোলে নিশ্চিত হয়ে যায় আর্জেন্টিনার জয়। স্বস্তির খুশি ফেরে অধিনায়কের মুখেও। 

এই হাসিটুকু নকআউট পর্বে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেনে নিতে যে মেসি মরিয়া, তা ফুটে ওঠে এদিনের প্রস্তুতির পরতে পরতে। অনুশীলনে নেমে তাই সতীর্থদের সঙ্গে খোশ-গল্প নয়, উনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন কাজে। পাসিং, শুটিং, রানিং, ড্রিবলিং-সবকিছুই তিনি করলেন ভীষণ মনোযোগ, একাগ্রতা নিয়ে। 

চোটের কারণে আনহেল দি মারিয়াকে সম্পন্ন ষোলোর ম্যাচে না পাওয়াটা কেবলমাত্র আর্জেন্টিনা নয়, মেসির জন্যও সুবিশাল ধকল হয়ে এসেছে। আক্রমণের সুর বেঁধে দেওয়ার বাড়তি দায়িত্ব এখন তার কাঁধে চেপে বসেছে। সে ভার বইতে একটু দেরিতে অনুশীলনে নামলেও মেসি এজন্য কাটাননি আলসে সময়। অতল মগ্নতায় নিজেকে শাণিত করতে থাকেন অনুক্ষণ। 

চার বছর আগে রাশিয়া বিশ্বকাপে সম্পন্ন ষোলোর লড়াইয়ে ফ্রান্সের কাছে হেরে বিদায় ঘণ্টা বেজেছিল আর্জেন্টিনার। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ষোলোর ম্যাচে সম্মুখীন হবে লাতিন আমেরিকার চ্যাম্পিয়নরা। ‘আসল পরীক্ষা’ শুরু হবে মেসিরও।