অ্যাপেল পার্ক

অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, অ্যাপল পার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা স্টিভ জবস চেয়েছিলেন এমন একটি অফিস তৈরি করতে, আপাতদৃষ্টিতে যাতে সেটাকে অফিস বলে মনে না হয়। সেটি যেন হয়ে ওঠে প্রকৃতি, স্থাপত্য ও প্রযুক্তির এক অসাধারণ মেলবন্ধন। 

Feb 13, 2023 - 17:21
 0
অ্যাপেল পার্ক
সংগ্রহীত ছবি

অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, অ্যাপল পার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা স্টিভ জবস চেয়েছিলেন এমন একটি অফিস তৈরি করতে, আপাতদৃষ্টিতে যাতে সেটাকে অফিস বলে মনে না হয়। সেটি যেন হয়ে ওঠে প্রকৃতি, স্থাপত্য ও প্রযুক্তির এক অসাধারণ মেলবন্ধন। 

ক্যাম্পাসটি তৈরির ঘোষণা ২০০৬ সালে দিলেও বিভিন্ন অনুমোদন এবং আইনি কাজ করতে আট বছর লেগে গিয়েছিল। 2013 সালের শেষের দিকে শুরু হওয়া অ্যাপেল পার্ক তৈরির কাজটি শেষ হয় 2017 সালে। ১৭৬ একর জমির উপর নির্মাণ করা হয় এই বিশাল আকারে ক্যাম্পাসটি। পুরো ক্যাম্পাসটি তৈরি করতে কোম্পানির খরচ হয়েছে ৫ বিলিয়ন ডলার। পরিবেশের কথা মাথায় রেখে ৮০ শতাংশ জায়গায় বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৭ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। ক্যাম্পাসে থাকা বিভিন্ন বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে আইফোনের হার্ডওয়ার এর সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে। সিরি থেকে বাথরুম সব জায়গায় অ্যাপেলের বিভিন্ন হার্ডওয়ারের মতো করে তৈরি করা হয়েছে। মূল ভবনটি দেখতে গোলাকার হওয়ার কারণে এর নামকরণ করা হয়েছে দ্যা রিং (The Ring)।

খুঁটিনাটি

  • ভবনটি তৈরির দায়িত্ব ছিল অন্য একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির। পরে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সেই কোম্পানি বদল হয়ে যায়।
  • এর রেপ্লিকা তৈরি করতেই লেগেছে প্রায় দুই বছর।
  • নকশার জন্য ‘স্পেসশিপ’ও বলা হয় একে।
  • প্রায় ৭৫ ভাগ কাজ পরিচালিত হয় সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে।
  •  ভবনে কোনোরূপ অনাকাক্সিক্ষত আলোর প্রতিফলন ঘটে না।
  • ভবনের দরজার হাতল তৈরি করতে সময় লেগেছে প্রায় দেড় বছর।
  • পার্ক করা যায় একসঙ্গে ১৪ হাজার ২০০ গাড়ি।
  • বিশাল এই ক্যাম্পাসের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে রয়েছে ১ হাজারেরও বেশি সাইকেল।

স্টিভ জবসের স্বপ্নের প্রকল্প অ্যাপল পার্ক

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের নবনির্মিত প্রধান কার্যালয় অ্যাপল পার্ক। নতুন এই ক্যাম্পাসটি অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়ার কুপারটিনোতে। এটি ইনফিনিট লুপ নামে পরিচিত প্রথম ক্যাম্পাসের এক মাইল দূরে।  

প্রায় ১৭৫ একর এলাকা জুড়ে অবস্থান করছে এই ক্যাম্পাস। গোলাকার ও চারতলা এই ভবনটির চারদিকে রয়েছে সবুজের ছোঁয়া।  

২০০৬ সালে অ্যাপলের সাবেক সিইও স্টিভ জবসের কাছ থেকে নতুন ক্যাম্পাসের ঘোষণা আসে। মূলত স্টিভ জবস তার জীবনের শেষ দুই বছর এই অ্যাপল ক্যাম্পাস নিয়েই কাজ করে গেছেন। মৃত্যুর মাস চারেক আগে তিনি কোপার্টিনো সিটি কাউন্সিল থেকে অনুমতি পাওয়ার জন্য এ ভবনের বিস্তারিত তথ্য জমা দেন।  ২০০৯ সালে এই প্রকল্পের দায়িত্ব দেন তিনি বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি নরম্যান ফস্টারকে। 

স্টিভের আমল থেকে অ্যাপলের ডিজাইন টিমের কাণ্ডারি ও প্রধান নকশাবিদ জনি আইভ। এ পর্যন্ত অসংখ্য অ্যাপল পণ্যের নকশা করেছেন জনি আইভ। মূলত, অ্যাপল পণ্যের ‘দৃষ্টি নান্দনিকতা’র বিষয়টির দেখভালের মূল দায়িত্বই তার। পর্দার পেছনে থেকে অ্যাপল পার্কের নকশা মূলত তিনিই করেছেন।   

পর্দার পেছনে জনি আইভ

স্টিভের আমল থেকে অ্যাপলের ডিজাইন টিমের কাণ্ডারি ও প্রধান নকশাবিদ জনি আইভ। এ পর্যন্ত অসংখ্য অ্যাপল পণ্যের নকশা করেছেন জনি আইভ। মূলত, অ্যাপল পণ্যের ‘দৃষ্টি নান্দনিকতা’র বিষয়টির দেখভালের মূল দায়িত্বই তার। পর্দার পেছনে থেকে অ্যাপল পার্কের নকশা মূলত তিনিই করেছেন।তিনি বলেন, ‘আমরা যেভাবে আমাদের পণ্য তৈরিতে নকশা ও এর বৈশিষ্ট্যে কী হবে সেটি নিয়ে উৎসাহী থাকি; আমাদের এই নতুন ক্যাম্পাস তৈরিতেও একই রকম নকশা, প্রকৌশল সৃজনশীলতার বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছিল।’

সবুজের ছোঁয়া ও বিশুদ্ধ পানি

পুরো অ্যাপল ক্যাম্পাসের প্রায় আশি ভাগ এলাকা জুড়ে রয়েছে সবুজের ছোঁয়া। লাগানো হয়েছে খরা প্রতিরোধী প্রায় ৯ হাজার গাছ। এর জন্য সাহায্য নেয়া হয়েছে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির। প্রধান ভবনের মাঝখানে মূল বাগান জুড়ে করা হয়েছে বিভিন্ন জাতের আপেলগাছ। পাশাপাশি রয়েছে খেজুর ও জলপাই, অ্যাপরিক্টের বাগানও। মাঝখানের ওই বাগানে রয়েছে বিশাল একটি পুকুর। যেহেতু পুরো ক্যালিফোর্নিয়াতেই রয়েছে বিশুদ্ধ পানির সমস্যা, আর পুরোপুরি এই ক্যাম্পাস চালু হলে প্রতিদিন প্রায় ১,৫৭,০০০ গ্যালন পানির প্রয়োজন হবে। তাই এখানে ব্যবহৃত পানি পরিশোধন করে ব্যবহার করা হয়।

বিশ্বের বৃহত্তম বাঁকানো কাচের কাঠামো

পুরো ক্যাম্পাসের মধ্যমণি একটি কেন্দ্রীয় চারতলা বৃত্তাকৃতি ভবন, যার অফিস স্পেস প্রায় ২৮ লাখ বর্গফুট বা দুই লাখ ষাট হাজার বর্গমিটার। ব্যাসার্ধ প্রায় এক মাইল। কী দিয়ে তৈরি হয়েছে বিশাল এই স্থাপনা? এর দেয়াল তৈরি করা হয়েছে শুধু কাচ দিয়ে। এর ভেতরের যে পার্টিশন, সেখানেও ব্যবহার করা হয়েছে কাচ।  প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, এটি নাকি বিশ্বের বৃহত্তম বাঁকানো কাচের কাঠামো। তবে এর কিছু অসুবিধার কথাও জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। কাচের দেয়াল এমনভাবে রয়েছে, অনেক সময় হাঁটতে গিয়ে সেখানে কোনো দেয়ালের অস্তিত্ব বোঝা যায় না। আর তাই কাজের মধ্যে ডুবে থাকা অনেক কর্মীই হাঁটতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছেন এ দেয়ালে। ফার্নিচারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে শুধু কাঠ। ফ্লোর ও সিলিং তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে বড় বড় পাথর ও কাঠের খণ্ড। ৪ হাজার ৩০০ খণ্ড ব্যবহার করা হয়েছে। শুনলে অবাক হবেন বিশালাকৃতির কিছু কিছু খণ্ডের ওজন নাকি প্রায় ২৭ টন।

৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্যাম্পাস

অ্যাপলের নতুন এই ক্যাম্পাস তৈরি করতে খরচ হয়েছে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। কী থাকছে সেই ৫০০ কোটি টাকার ক্যাম্পাসে? চলুন দেখে নিই এই ভবনে রয়েছে এক লাখ বর্গফুট জুড়ে একটি ফিটনেস সেন্টার, যা একসঙ্গে প্রায় ২০ হাজার লোক ব্যবহার করতে পারে। তবে তা শুধু অফিসের লোকদের জন্য। তিন লাখ বর্গফুট বা ২৮ হাজার বর্গমিটার জুড়ে রয়েছে গবেষণা ও বিকাশকেন্দ্র। কর্মীদের হাঁটা-চলার জন্য রয়েছে প্রায় দুই মাইল এলাকা জুড়ে রাস্তা। ৮৩ হাজার বর্গফুটের মিটিং স্পেস। রয়েছে প্রায় ১১ হাজার গাড়ি একসঙ্গে পার্ক করার জন্য স্মার্ট পার্কিং লাউঞ্জ। নিশ্চিত করা হয়েছে শতভাগ নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার।

রয়েছে সাতটি ক্যাফে। সব থেকে বড় যে ক্যাফে সেটাতে একসঙ্গে তিন হাজার লোক নাশতা করতে পারে। চারদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এসব ক্যাফে আলোকিত হয় সূর্যালোক দ্বারা। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য রয়েছে ক্যানটিন। ১৫ হাজার লোক যাতে দুপুরের খাবার খেতে পারেন, তার জন্য রয়েছে বিশেষভাবে ডিজাইন করা অফিসের সঙ্গে মানানসই পরিবেশবান্ধব ৫০০ টেবিল।

বিশাল এই ভবনের ফিটিংসের কাজ করা হয়েছে আইফোনের হার্ডওয়্যারের নকশাগুলোর সঙ্গে মিল রেখে। অ্যাপলের নতুন ভবনের বাথরুম থেকে লিফট সব জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে অ্যাপলের তৈরি বিভিন্ন ল্যান্ডমার্ক হার্ডওয়্যারের নকশা। এমনকি অ্যালিভেটরের বাটনগুলো তৈরি করা হয়েছে আইফোনের হোম বাটনের মতো করে। ভবনের সিলিং প্যানেলগুলো তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে উচ্চমানের পলিশড কংক্রিট। নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে সূক্ষ্ম মানও।

এসি ছাড়া ৯ মাস

অ্যাপল পার্কের ভবন স্বাভাবিকভাবেই বায়ু চলাচলযুক্ত। যার ফলে এটিতে শীতলকরণ যন্ত্র বা গরম করার যন্ত্র ব্যবহার করতে হয় না। বছরের প্রায় ৯ মাসই তাই এ ভবনে এসি চালানোর প্রয়োজন পরে না। তবে এর জন্য অবশ্য নতুন কিছু প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি।

এই ক্যাম্পাসটিতে আলাদা টেবিলের পরিবর্তে বড় টেবিলের চারপাশে বসে সবাই অফিস করে। আন্তরিকতা ও সহযোগী তার মনোভাব বৃদ্ধির জন্যই এ ব্যবস্থা।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অ্যাপল কোম্পানি নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। অ্যাপল পার্কও ব্যতিক্রম নয়। ২০১৬ সালের মার্চে এক ইভেন্টে অ্যাপল সিইও টিম কুক বলেন, ‘অ্যাপলের জন্য স্টিভের দূরদৃষ্টি তার সময়কে অতিক্রম করেও আমাদের সঙ্গে রয়েছে। স্টিভ জবস চেয়েছিলেন অ্যাপল পার্ক হবে আগামী প্রজন্মের জন্য উদ্ভাবনের কেন্দ্র। আমরা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তি সাশ্রয়ী ভবন নির্মাণ করেছি এবং ক্যাম্পাসটি চালানো হবে পুরোপুরি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে।’

শুধু অ্যাপল ক্যাম্পাসের জন্য একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে, যা প্রাকৃতিক গ্যাস বা অন্যান্য পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে চলে। বৃত্তাকার প্রধান ভবনটির পুরো ছাদ সৌর প্যানেল দিয়ে আচ্ছাদিত। এখান থেকে উৎপন্ন হয় ১৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। শতভাগ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রায় ৩০০ ইলেকট্রিক কার চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow